ইরাকের একনায়ক সাদ্দাম হোসেনের জীবনী

সাদ্দাম হোসেন, জীবনী

Mar 16, 2025 - 04:47
 0  1
ইরাকের একনায়ক সাদ্দাম হোসেনের জীবনী
ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন

সাদ্দাম হোসেনের পূর্ণাঙ্গ জীবনী

পূর্ণ নাম সাদ্দাম হোসেন আল-মাজিদ আল-তিক্রিতি
জন্ম ২৮ এপ্রিল, ১৯৩৭
জন্মস্থান আল-আউজা, তিকরিত, ইরাক  
মৃত্যু ৩০ ডিসেম্বর, ২০০৬ (৬৯ বছর বয়সে)  
পিতা হোসেন আল-মাজিদ  
মাতা সাবাহ আল-জাবুরী  
পেশা রাজনীতিক, সেনাপ্রধান  
ধর্ম ইসলাম (সুন্নি)  
পদবী ইরাকের প্রেসিডেন্ট (১৯৭৯–২০০৩)

প্রাথমিক জীবন এবং পরিবার

সাদ্দাম হোসেনের জন্ম ১৯৩৭ সালের ২৮ এপ্রিল, ইরাকের উত্তরাঞ্চলীয় তিকরিত শহরের আল-আউজা গ্রামে। তার পিতা ছিলেন হোসেন আল-মাজিদ, এবং তার মা সাবাহ আল-জাবুরী। সাদ্দামের পরিবার ছিল দরিদ্র, এবং তিনি তার শৈশব কাটিয়েছিলেন এক কঠিন পরিবেশে। তার পিতার মৃত্যুর পর, সাদ্দাম তার মায়ের কাছে বেড়ে ওঠেন, এবং তার প্রাথমিক শিক্ষা ছিল খুবই সীমিত। তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন, তবে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু হয় সেসময়।

রাজনৈতিক ক্যারিয়ার

সাদ্দাম হোসেনের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৫৭ সালে, যখন তিনি **আরব সোশ্যালিস্ট বাথ পার্টি** (Ba'ath Party) তে যোগ দেন। বাথ পার্টি তখন ইরাকের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ছিল, যা আরব জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্রের সমর্থক ছিল। 

১৯৬৮ সালে, সাদ্দাম হোসেন বাথ পার্টির সহায়তায় ইরাকে **বিশ্বস্ত শাসক** হিসেবে উঠে আসেন। এই সময়ে সাদ্দাম ইরাকের সহ-প্রধান সেনাপ্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন, এবং খুব দ্রুত তার শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে।

প্রেসিডেন্ট পদে অভিষেক

১৯৭৯ সালে, সাদ্দাম হোসেন ইরাকের **৩৪তম প্রেসিডেন্ট** হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল একজন কট্টর বিরোধী এবং বাথ পার্টির একনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে, কিন্তু প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তিনি একক শাসক হিসেবে ইরাকের সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে আসেন। সাদ্দাম হোসেন ইরাকে এক তুঙ্গে শক্তিশালী শাসক হিসেবে অবস্থান গড়ে তুলেন। 

শাসনকাল

১. ইরান-ইরাক যুদ্ধ (১৯৮০-১৯৮৮):
১৯৮০ সালে সাদ্দাম হোসেন ইরানের ইসলামি বিপ্লবী নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ইরান-ইরাক যুদ্ধ (১৯৮০-১৯৮৮) এক দীর্ঘ ও বিধ্বংসী সংঘর্ষে পরিণত হয়। ইরাকের শাসক হিসেবে সাদ্দাম তার দেশকে একটি দীর্ঘ ৮ বছরব্যাপী যুদ্ধের মধ্যে ডুবিয়ে দেন। যুদ্ধের ফলে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারায় এবং ইরাক ও ইরান উভয়ের অর্থনৈতিক পরিণতি মারাত্মক হয়। 

২. কুয়েত আক্রমণ (১৯৯০):
১৯৯০ সালে, সাদ্দাম হোসেন কুয়েতের প্রতি তার দখলদারি দাবি করতে শুরু করেন এবং ২ আগস্ট, ১৯৯০, তিনি কুয়েতে আক্রমণ করেন। এর ফলে, কুয়েত ইরাকের দ্বারা দখল হয়ে যায় এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে **যুক্তরাষ্ট্র**, এই আক্রমণের বিরুদ্ধে একত্রিত হয় এবং ১৯৯১ সালে **গালফ যুদ্ধ** (Operation Desert Storm) শুরু হয়। সাদ্দামের সৈন্যরা কুয়েত থেকে বিতাড়িত হয়, এবং ইরাকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

৩. জাতিগত নিপীড়ন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন:
সাদ্দাম হোসেনের শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ব্যাপক ছিল। তার শাসনামলে বিভিন্ন জাতিগত সংখ্যালঘু, বিশেষত **কুর্দি** জনগণের উপর অত্যাচার ও নিপীড়ন চালানো হয়। ১৯৮৮ সালে, সাদ্দাম সরকার **হালাবজা শহরে** কুর্দি জনগণের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে, যাতে হাজার হাজার কুর্দি নিহত হয়। তাকে গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত করা হয়। এছাড়া, তিনি **শিয়া মুসলিমদের** উপরও কঠোর দমনপীড়ন চালিয়েছিলেন।

৪. ২০০৩ সালের মার্কিন আক্রমণ:
২০০৩ সালে, সাদ্দাম হোসেনের শাসনকে উৎখাত করতে **যুক্তরাষ্ট্র** এবং তাদের মিত্র দেশগুলি ইরাক আক্রমণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের নেতৃত্বে পরিচালিত এই আক্রমণের কারণ হিসেবে ইরাকের **বিধ্বংসী অস্ত্র** (WMD) থাকার সন্দেহ উল্লেখ করা হয়। সাদ্দামকে উৎখাত করা হয় এবং তাকে গ্রেফতার করা হয় ২০০৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর।

সাদ্দাম হোসেনের বিচার এবং মৃত্যুদণ্ড

গ্রেফতার হওয়ার পর সাদ্দাম হোসেনকে **ইরাকের আদালতে** বিচারের সম্মুখীন করা হয়। তাকে ১৯৮২ সালে শিয়া মুসলিমদের হত্যার জন্য এবং ১৯৮৮ সালের কুর্দি গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত করা হয়। ২০০৬ সালের ৫ নভেম্বর, ইরাকি আদালত সাদ্দাম হোসেনকে **মৃত্যুদণ্ড** দেয়। ৩০ ডিসেম্বর, ২০০৬, সাদ্দাম হোসেনকে **ফাঁসি দেওয়া হয়**। তার মৃত্যুর পর ইরাকে ব্যাপক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, এবং তার সমর্থকরা তাকে একটি মার্টির মতো শ্রদ্ধা করতে থাকেন।

সাদ্দাম হোসেনের উত্তরাধিকার
সাদ্দাম হোসেনের শাসনকালে ইরাকে তার শক্তিশালী কর্তৃত্ব ছিল, কিন্তু তার শাসনকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে আসে তার গণহত্যামূলক কার্যকলাপ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি, এবং ইরাকে জাতিগত সংঘর্ষ। সাদ্দামের মৃত্যুর পর, ইরাকের রাজনীতিতে এক নতুন যুগের সূচনা হয়, কিন্তু তার শাসনের ছায়া আজও ইরাকি জনগণের মাঝে রয়েছে। 

সাদ্দামের জীবনের প্রধান দিক:
একনায়কতন্ত্র: সাদ্দাম হোসেন ইরাককে একনায়কতন্ত্র শাসনের অধীনে পরিচালনা করেছিলেন, যেখানে সব ক্ষমতা তার হাতে ছিল।
গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন:সাদ্দামের শাসনে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিশেষ করে কুর্দি ও শিয়া মুসলিমদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের ঘটনা ঘটে।
ইরাকের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: তার শাসন আমলে, ইরাক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নানা সমস্যায় জড়িত ছিল, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল ইরান-ইরাক যুদ্ধ এবং কুয়েত আক্রমণ।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাত: সাদ্দাম হোসেনের শাসন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নানা সংঘাতের জন্ম দেয়, যার ফলে ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ এবং সাদ্দামের পতন ঘটে।

সাদ্দাম হোসেনের জীবন ছিল এক অত্যন্ত বিতর্কিত, শাসনকালে একটি বিপর্যয়কর একনায়কতান্ত্রিক শাসক এবং তার শাসনের পরবর্তী সময়ে ইরাকে এক গভীর অস্থিরতার সৃষ্টি হয়।

What's Your Reaction?

Like Like 0
Dislike Dislike 0
Love Love 0
Funny Funny 0
Angry Angry 0
Sad Sad 0
Wow Wow 0