মুঘল সম্রাট আকবরের জীবনী
মুঘল সম্রাট আকবর, জীবনী

বিষয় | বিস্তারিত |
---|---|
পূর্ণ নাম | আবু ফতেহ সিরাজ-উদ-দীন মুহাম্মদ আকবর |
জন্ম তারিখ | ১৫০০ সালের ১৫ অক্টোবর (হিজরি ৯০৭) |
জন্মস্থান | আম্বের (বর্তমান রাজস্থান, ভারত) |
পিতা | সম্রাট হুমায়ুন |
মাতা | মাহাম আঙ্গা |
শাসনকাল | ১১ নভেম্বর ১৫৫৬ – ৩ অক্টোবর ১৬۰৫ (৪৯ বছর) |
বিয়ের সংখ্যা | ৩টি স্ত্রী (মইমুনা, সেলিমা, এবং রত্তান বেগম) |
সন্তান | সম্রাট সেলিম (জম্মু, পরবর্তীতে সম্রাট জাহাঙ্গীর) |
মৃত্যু | ৩ অক্টোবর, ১৬০৫ (৫৪ বছর বয়স) |
ধর্ম | ইসলাম (শিয়া মুসলিম) |
রাজধানী | আগ্রা ও ফতেহপুর সিক্রি (সম্ভবত প্রধানত) |
বিখ্যাত উপাধি | আকবর-ই-আজম (বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ আকবর) |
প্রাথমিক জীবন ও পিতার শাসন
সম্রাট আকবরের জন্ম ১৫০০ সালের ১৫ অক্টোবর, আম্বের (বর্তমান রাজস্থান, ভারত) শহরে। তাঁর পিতা ছিলেন মুঘল সম্রাট হুমায়ুন এবং মা ছিলেন মাহাম আঙ্গা। হুমায়ুনের জীবনে একাধিক যুদ্ধ ও সংগ্রাম ছিল, ফলে আকবর খুব ছোট বয়সে রাজপরিবারের সাথে নানা বিপদের মধ্যে বেড়ে ওঠেন। আকবরের জন্মের আগে, হুমায়ুন কিছুটা অসফল ছিলেন এবং ১৫৪০ সালে শের শাহ সুরির হাতে সাম্রাজ্য হারান।
আকবরের জন্মের পর, ১৫৪০ সালে তাঁর বাবা হুমায়ুন আবার দখল ফিরে পাওয়ার জন্য শের শাহ সুরির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চলে যান। এই সময় আকবর ও তাঁর মা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ছিলেন। হুমায়ুনের মৃত্যুর পর আকবর ১৩ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করেন, কিন্তু তখন তাকে একজন মুঘল সেনাপতি বারাম খান ও মীরা মুসতান বেগমের মতো অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা সাহায্য করেছিলেন।
রাজত্ব শুরু ও অগ্রগতির প্রথম দিন
আকবর যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। প্রথমে, সিংহাসনের ভার ছিল সেনাপতি বারাম খানের ওপর, কিন্তু পরবর্তীতে আকবর নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়া শুরু করেন। তার শাসনকালে তিনি সবধরণের প্রশাসনিক ও সামরিক সংস্কার করেন এবং ভারতবর্ষের নানা রাজ্য ও জাতির মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাজ করেন।
দিগন্ত প্রসার ও সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা
আকবরের শাসনকালে, মুঘল সাম্রাজ্যটি অনেক প্রশস্ত হয়ে ওঠে। তাঁর শাসনামলে, মুঘল সাম্রাজ্য উত্তর ভারতে বিস্তৃত হয়ে ওঠে, এবং তিনি রাজস্থান, মধ্যভারত, গুজরাত, বাংলাসহ বহু অঞ্চল জয় করেন। তার যুদ্ধ কৌশল, রাজনৈতিক মেধা ও ক্ষমতার প্রচারণা তাকে এক মহান শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
বড় বড় বিজয়:
- চন্দেরি যুদ্ধ (۱۵५৬): আকবরের প্রথম বড় যুদ্ধ ছিল চন্দেরি যুদ্ধ, যা সেরা সাফল্য এনে দেয়।
- গুজরাতের জয় (১৫৬৫): আকবর গুজরাতের শাসক মেহের আলি খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গুজরাত জয় করেন।
- রাজস্থান এবং মধ্যভারতের জয়: রাজস্থানের রাজপুতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমে তিনি বেশ কিছু অঞ্চলে দখল অর্জন করেন, বিশেষত মওয়ার, জয়পুর ও চিতোর।
ধর্মীয় নীতি ও প্রশাসনিক সংস্কার
আকবরের শাসনকাল ধর্মীয় সহনশীলতার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। তিনি সকল ধর্মের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়কে একত্রিত করার জন্য প্রচেষ্টা চালান। আকবর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দীন-ই-ইলাহী নামে একটি ধর্মীয় আদর্শ যা মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ধর্মের মধ্যে সমন্বয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ছিল।
ধর্মীয় নীতি এবং সহনশীলতা:
আকবরের শাসনকালে, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি একদিকে ইসলাম ধর্মের অনুসারী ছিলেন, তবে অন্যদিকে তার রাজত্বে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, জৈন, পার্সি এবং অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকেরা একসঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতেন। আকবরের ধর্মীয় নীতির মধ্যে বিশেষভাবে দুটি প্রধান বিষয় ছিল:
-
-
দীন-ই-ইলাহী (Din-i-Ilahi):
- ১৫৮২ সালে আকবর তার নিজস্ব ধর্মীয় দর্শন প্রতিষ্ঠা করেন, যা "দীন-ই-ইলাহী" নামে পরিচিত। এটি মূলত মুসলিম, হিন্দু এবং অন্যান্য ধর্মের সঠিক উপাদানগুলিকে একত্রিত করে একটি ধর্মীয় আদর্শ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিল। যদিও এই ধর্ম ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়নি, তবে এটি আকবরের ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রকাশ।
-
জিজিয়া কর তুলে দেওয়া:
- আকবর ১৫৭৯ সালে হিন্দুদের উপর আরোপিত জিজিয়া কর (যা মুসলিম শাসকরা হিন্দুদের উপর আরোপ করেছিল) তুলে দেন, যা তার ধর্মীয় সহিষ্ণুতার অন্যতম একটি প্রতীক ছিল।
-
মুক্ত মনীষীদের সঙ্গে সম্পর্ক:
- আকবর তার রাজ court-এ বিভিন্ন ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং বৌদ্ধিক দিক থেকে উজ্জ্বল ব্যক্তিদের আহ্বান করতেন। তার রাজ court এর মধ্যে ছিল বীরবল, ফৈজি, তানসেন, আবুল ফজল, রুই দাস, শাহ মহম্মদ, ইত্যাদি, যারা মুঘল রাজকীয় সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
-
প্রশাসনিক সংস্কার:
- আকবর প্রশাসনে দক্ষতা প্রদর্শন করেছিলেন। তিনি প্রদেশগুলিতে শক্তিশালী এবং দক্ষ শাসকদের নিয়োগ করেছিলেন।
- রাজস্ব ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, বিশেষ করে অকবরি ব্যবস্থাপনা, যা ছিল তাঁর রাজস্ব সংগ্রহের একটি আধুনিক পদ্ধতি।
- তিনি আকবরের দ্বারশালা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেখানে বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী দলে একত্রিত হতেন।
সামাজিক সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান
আকবরের রাজত্বে সংস্কৃতি, শিল্পকলা এবং বিজ্ঞানে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে। তিনি বিশেষভাবে শিল্পী, সাহিত্যিক এবং বিজ্ঞানীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। আকবরের রাজ court ছিল এক শিল্প-সংস্কৃতি কেন্দ্র, এবং তার দোরে অনেক বুদ্ধিজীবী, কবি, দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী আসতেন।
তিনি আলী সিরাজী, বীরবল, ফৈজি, তানসেন এর মতো ব্যক্তিদের রাজ court এ নিয়ে আসেন, যারা পরে মুঘল রাজকীয় সংস্কৃতির অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
আকবরের মৃত্যু ও উত্তরাধিকারী
সম্রাট আকবর ৩ অক্টোবর ১৬০৫ সালে আকবরের শাসনকালে আগ্রায় মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর, তার পুত্র সেলিম রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন এবং পরবর্তীতে তিনি সম্রাট জাহাঙ্গীর হিসেবে পরিচিত হন।
সারাংশ
আকবর ছিলেন ভারতীয় ইতিহাসের অন্যতম মহান শাসক, যিনি শুধুমাত্র সামরিক বিজয়ে নয়, তার প্রশাসনিক দক্ষতা, ধর্মীয় সহনশীলতা, সংস্কৃতির বিকাশ এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার শাসনকালে মুঘল সাম্রাজ্য এক শক্তিশালী ও সুসংহত রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
What's Your Reaction?






