কিংবদন্তীর রাষ্ট্রনায়ক নেলসন ম্যান্ডেলা
নেলসন ম্যান্ডেলা,জিবনী

নেলসন ম্যান্ডেলা (Nelson Mandela) ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার এক মহান নেতা, যে দেশের মুক্তির জন্য লড়াই করেছিলেন এবং বিশ্বের এক প্রধান শান্তিকামী নেতারূপে পরিচিত ছিলেন। তার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকার অত্যাচারিত কালো জনগণ উপনিবেশিক শাসন এবং বর্ণবাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছিল। ম্যান্ডেলা তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কারাগারে কাটালেও, তিনি দেশের প্রথম কালো প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে একটি নতুন যুগের সূচনা করেন।
প্রাথমিক জীবন
|
নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার এক খ্রিস্টান বংশোদ্ভূত ম্যান্ডেলা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম ছিল "রোলিহলাহা," যার অর্থ "বিপত্তি সৃষ্টিকারী।" তার পিতা ছিলেন একটি ক্ষুদ্র উপজাতীয় গ্রামটির চিফ (প্রধান) এবং ম্যান্ডেলার পরিবার ছিল মধ্যবিত্ত। তিনি অল্প বয়সেই তার পিতাকে হারান এবং তার শিক্ষার শুরু হয় গ্রামের একটি স্কুলে। ম্যান্ডেলা ছিলেন উটথাতার সিজওবা গোত্রের অন্তর্গত।
শিক্ষা জীবন:
ম্যান্ডেলা যখন ছোট ছিলেন, তখন তিনি মেথডিস্ট মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করেন, এবং পরে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু এই শিক্ষা জীবন চলাকালে তাকে কিছু বাধার সম্মুখীন হতে হয়, কারণ তার পরিবার ও জাতির প্রতি বর্ণবাদী শাসনের কঠোর নীতি তাকে প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করছিল।
তিনি আইন শাস্ত্রে পড়াশোনা শেষ করার পর, ১৯৪১ সালে যোগ দেন প্রিটোরিয়ার একটি আইন অফিসে এবং সেখানে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন।
রাজনৈতিক জীবন এবং সংগ্রাম:
ম্যান্ডেলা রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ করেন ১৯৪০-এর দশকে, যখন তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (ANC) দলের সাথে যুক্ত হন। ১৯৪৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার বর্ণবাদী নীতি গ্রহণ করে এবং কালো জনগণের অধিকার সীমিত করা হয়, যা ম্যান্ডেলাকে সহিংস প্রতিবাদ ও আন্দোলনের দিকে ঠেলে দেয়।
ম্যান্ডেলা "নিরীহ প্রতিরোধ" আন্দোলনের মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেন। ১৯৬১ সালে ANC’র একটি সহিংস শাখা তৈরি করে এবং তিনি সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেন। এই আন্দোলন দক্ষিণ আফ্রিকার শাসক শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে ছিল, যারা কালো জনগণের প্রতি নিপীড়ন চালাতো।
কারাবাস:
১৯৬২ সালে ম্যান্ডেলাকে আটক করা হয় এবং ১৯৬৪ সালে রাবিনসন বিচারক নীতি অনুসারে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। তিনি ২৭ বছর কারাগারে ছিলেন, তার বেশিরভাগ সময়টি রবেন দ্বীপের কারাগারে কাটান। তার কারাবাস একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলনের সৃষ্টি করে, এবং তিনি বিশ্বব্যাপী সমর্থন পান।
মুক্তি এবং প্রেসিডেন্ট হওয়া:
১৯৯০ সালে, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট ফ্রেডরিক উইলেম ডি ক্লার্ক ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা দেন। এরপর তিনি ANC’র নেতৃত্বে ফিরে আসেন এবং শান্তিপূর্ণভাবে জাতিগত ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম মুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, এবং নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কালো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ:
ম্যান্ডেলা প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশকে একত্রিত করতে এবং বর্ণবাদী সিস্টেম ভেঙে নতুন একটি সংবিধান তৈরি করতে কাজ করেন। তার নেতৃত্বে, তিনি দেশের সব জনগণের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করেন এবং একটি বর্ণবাদ মুক্ত দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিষ্ঠা ঘটান।
শান্তি এবং গণতন্ত্র:
প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ম্যান্ডেলা গঠনমূলক শান্তি এবং সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছেন। তার নেতৃত্বে, তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার জাতিগত বিভাজন কাটাতে সমঝোতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করেন। তিনি একাত্মতার পথে কাজ করার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কারও পান ১৯৯৩ সালে।
পরবর্তী জীবন এবং মৃত্যু:
রিসাইন করার পর, ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার গঠনমূলক সমাজ গড়তে কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ২০০০ সালের পর একটি সামজিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন এবং এই সময়ে বহু দাতব্য কাজেও যুক্ত হন, বিশেষ করে এইডস রোগের বিরুদ্ধে লড়াই ও শিক্ষার প্রসারে।
নেলসন ম্যান্ডেলা ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর ৯৫ বছর বয়সে মারা যান। তার মৃত্যুতে বিশ্বব্যাপী শোকের ছায়া নেমে আসে এবং তিনি চিরকাল একজন আইকনিক নেতারূপে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
উত্তরাধিকার:
ম্যান্ডেলা ছিলেন "শান্তি ও সমতার পক্ষে সংগ্রামকারী একজন কিংবদন্তি।" তার অবদান দক্ষিণ আফ্রিকায় এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বর্ণবাদ এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত হয়।
What's Your Reaction?






