হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) এর পূর্ণাঙ্গ জীবনী
হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) এর পূর্ণাঙ্গ জীবনী

🌟 হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) এর পূর্ণাঙ্গ জীবনী
১. জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়
হযরত ওমর (রাঃ) জন্মগ্রহণ করেন আরব উপদ্বীপের প্রসিদ্ধ কুরাইশ গোত্রের ‘বানু আদি’ শাখায়, আনুমানিক ৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে, মক্কা নগরীতে। তাঁর পিতার নাম ছিল খাত্তাব ইবনে নুফাইল এবং মাতার নাম হানতা বিনতে হিশাম। তিনি ছিলেন মক্কার সম্ভ্রান্ত বংশের একজন শক্তিশালী ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি। তিনি শৈশবেই কাব্য, যুদ্ধশাস্ত্র, ইতিহাস ও রীতিনীতিতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন এবং অল্প বয়সেই কুরাইশদের একজন পরামর্শদাতা হিসেবে বিবেচিত হন।
২. ইসলাম-পূর্ব জীবন
ইসলাম গ্রহণের পূর্বে হযরত ওমর (রাঃ) ছিলেন ইসলাম ও নবী করীম (সাঃ)-এর বিরুদ্ধাচরণে সক্রিয়। তিনি মুসলমানদের উপর অত্যাচার করতেন এবং এক সময় সিদ্ধান্ত নেন যে, মুহাম্মদ (সাঃ)-কে হত্যা করে ইসলামকে চিরতরে মুছে ফেলবেন। তবে এই সিদ্ধান্তই তাঁকে সত্যের পথে এনে দেয়। যখন তিনি নবীজির সন্ধানে রওনা হন, তখন এক ব্যক্তি তাঁকে জানান যে, তাঁর নিজের বোন ও দুলাভাই ইতোমধ্যে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁদের বাড়িতে যান, কিন্তু কুরআনের তেলাওয়াত শুনে কাঁদতে থাকেন এবং পরে রাসূল (সাঃ)-এর কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন।
৩. ইসলাম গ্রহণ ও প্রভাব
হযরত ওমর (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণ ছিল ইসলামের ইতিহাসে এক মাইলফলক। তখন মুসলমানরা গোপনে নামাজ আদায় করতেন ও লুকিয়ে ইবাদত করতেন। কিন্তু ওমর (রাঃ) মুসলিম হওয়ার পর সাহস পেয়ে মুসলমানরা প্রকাশ্যে কাবা শরীফে গিয়ে জামাআতে নামাজ আদায় করতে থাকেন। তিনি ছিলেন সেই বিশিষ্ট সাহাবীদের একজন, যাঁদের ইসলাম গ্রহণ ইসলামের ইতিহাসে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। রাসূল (সাঃ) তাঁকে “আল-ফারুক” উপাধি দিয়েছিলেন — অর্থাৎ যিনি সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্য করতে সক্ষম।
৪. রাসূল (সাঃ)-এর ঘনিষ্ঠ সাহাবী
ইসলাম গ্রহণের পর হযরত ওমর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অন্যতম প্রধান সাথী হিসেবে পরিগণিত হন। হিজরতের সময় তিনি প্রকাশ্যে মক্কা ত্যাগ করেন এবং ঘোষণা দেন — “যে ব্যক্তি তার স্ত্রীকে বিধবা করতে চায়, সন্তানকে এতিম করতে চায়, সে যেন আমায় রুখে দেয়।” মদিনায় এসে তিনি সব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, বিশেষ করে বদর, উহুদ, খন্দক, হুদায়বিয়া চুক্তি ও হুনাইন যুদ্ধে তাঁর সাহসিকতা ও প্রজ্ঞা প্রশংসনীয় ছিল।
৫. খিলাফত লাভ
হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) মৃত্যুর আগে পরামর্শক্রমে হযরত ওমর (রাঃ)-কে খলিফা মনোনীত করেন। ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে (১৩ হিজরি) তিনি দ্বিতীয় খলিফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর খিলাফতকাল ছিল ১০ বছর ৬ মাস — ইসলামের ইতিহাসে এটি ছিল এক মহান শাসনামল।
৬. প্রশাসনিক ও ধর্মীয় সংস্কার
হযরত ওমর (রাঃ)-এর শাসনামল ছিল সুব্যবস্থাপনা ও ন্যায়বিচারের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি সর্বপ্রথম ‘বায়তুল মাল’ বা রাষ্ট্রীয় কোষাগার গঠন করেন। তিনি হিজরি সনের প্রবর্তন করেন, রাষ্ট্রীয় বাজেট, সেনাবাহিনীর তালিকা, আদালত ব্যবস্থা, রাজস্ব আদায়, পয়ঃনিষ্কাশন, রাস্তা, মসজিদ নির্মাণ ইত্যাদি ব্যাপারে সুসংগঠিত ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। তিনি প্রদেশগুলিতে বিচারক ও গভর্নর নিয়োগ করে প্রশাসনকে শক্তিশালী করেন।
৭. ভূ-রাজনৈতিক বিজয় ও সাম্রাজ্য বিস্তার
তাঁর শাসনামলে ইসলামী সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। পারস্যের কাদিসিয়া ও নেহাভান্দ যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে সম্পূর্ণ পারস্য বিজয় হয়। বাইজেন্টাইন খ্রিস্টান সাম্রাজ্যের বহু অঞ্চল যেমন সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও মিশর তাঁর শাসনে আসে। বিখ্যাত জেরুজালেম শহর (বায়তুল মুকাদ্দাস) হযরত ওমর (রাঃ)-এর হাত ধরে মুসলমানদের হাতে শান্তিপূর্ণভাবে আসে। তিনি নিজ হাতে শহরের সুরক্ষা ও গীর্জাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।
৮. ব্যক্তিত্ব ও চারিত্রিক গুণাবলী
হযরত ওমর (রাঃ) ছিলেন কঠোর ন্যায়পরায়ণ, বিনয়ী, কর্মঠ ও জনসেবাপরায়ণ শাসক। তিনি নিজেই রাতের আঁধারে নগর পরিদর্শন করতেন, গরিব-দুঃখীর সেবা করতেন। তিনি কখনো রাজসিকতা গ্রহণ করেননি। এমনকি বায়তুল মাল থেকে সামান্য কিছু নিতেন, যা তাঁর প্রয়োজনেই সীমাবদ্ধ থাকত। একবার একজন ব্যক্তি তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে — ওমর (রাঃ) বিচারকের সামনে সাধারণ মানুষের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন।
৯. শাহাদাত ও মৃত্যুবরণ
৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দে, ২৬ হিজরিতে, এক পারস্যি দাস আবু লু'লু ফেইরুজ ফজরের নামাজে তাঁকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে। তিনি ছয়টি ছুরিকাঘাতের শিকার হন এবং তিনদিন মৃত্যুশয্যায় থাকার পর শাহাদত বরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি খলিফা নির্বাচনের জন্য ছয়জন সাহাবীর একটি পরামর্শ পরিষদ (শূরা) গঠন করে যান।
১০. সমাধিস্থান
তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী, হযরত ওমর (রাঃ)-কে মদিনায় মসজিদে নববী-তে, রাসূল (সাঃ) ও হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর পাশে সমাহিত করা হয়। এটি আজও ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে পবিত্র স্থানগুলোর একটি।
🔖 উপসংহার
হযরত ওমর (রাঃ) ছিলেন ইসলামী ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক, ন্যায়বিচারক ও সংস্কারক। তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা, আধ্যাত্মিকতা এবং ব্যক্তিগত চারিত্রিক দৃঢ়তা মুসলিম উম্মাহর জন্য চিরকাল আদর্শ হয়ে থাকবে। বিশ্বের যেকোনো শাসকের জন্য তাঁর জীবন এক উজ্জ্বল পথপ্রদর্শক।
Tags:
What's Your Reaction?






