হজরত খাদিজা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)-এর জীবনী
হজরত খাদিজা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)-এর জীবনী

B📘 হজরত খাদিজা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ, বিস্তারিত ও প্রামাণ্য জীবনী
🟩 ১ম অধ্যায়: জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়
হজরত খাদিজা (রা.) কুরাইশ গোত্রের এক সম্ভ্রান্ত ও ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা খুয়াইলিদ ইবনে আসাদ ছিলেন মক্কার একজন সম্মানিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। মা ফাতিমা বিনতে যায়েদও কুরাইশ বংশের নারী ছিলেন।
-
জন্মসন: আনুমানিক ৫৫৫ খ্রিস্টাব্দ
-
জন্মস্থান: মক্কা নগরী
-
উপাধি: “আত-তাহিরা” (বিশুদ্ধ নারী), “উম্মুল মুমিনীন” (বিশ্বাসীদের মা)
খাদিজা (রা.)-এর বংশপরিচয় ছিল রাসূল (সা.)-এর বংশের সঙ্গে সংযুক্ত। তাঁরা উভয়েই কুসাই ইবনে কিলাবের বংশধর।
🟩 ২য় অধ্যায়: বাল্যকাল ও চরিত্র
ছোটবেলা থেকেই খাদিজা (রা.)-এর মধ্যে মেধা, শান্ত স্বভাব, সদাচরণ ও মহানুভবতার পরিচয় দেখা যায়। তিনি সমাজে নারীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় নিজেকে অগ্রণী করে তোলেন। সততা, দানশীলতা ও চরিত্রের পবিত্রতার কারণে তাঁকে "আত-তাহিরা" উপাধি দেওয়া হয়।
🟩 ৩য় অধ্যায়: ব্যবসায়িক জীবন
খাদিজা (রা.)-এর পিতা ছিলেন বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের অধিকারী। পিতার মৃত্যুর পর তিনি নিজে ব্যবসা পরিচালনা শুরু করেন। তাঁর ব্যবসায়িক কাফেলা সিরিয়া, ইয়ামান প্রভৃতি অঞ্চলে যেত।
-
তিনি সরাসরি ব্যবসা না করে বিশ্বস্ত প্রতিনিধি নিযুক্ত করতেন।
-
এই ব্যবসায়িক প্রতিনিধি নিয়োগেই একসময় তিনি মুহাম্মদ (সা.)-কে ব্যবসার জন্য নিযুক্ত করেন।
🟩 ৪র্থ অধ্যায়: রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে প্রথম পরিচয়
মুহাম্মদ (সা.) তখন ২৫ বছরের যুবক, সৎ, আমানতদার, প্রভুর ভক্ত। তিনি ছিলেন জনশ্রুতির “আল-আমিন”। খাদিজা (রা.)-এর ব্যবসায়ের জন্য যখন প্রতিনিধি প্রয়োজন হয়, তখন তিনি মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়োগ দেন।
মুহাম্মদ (সা.) সিরিয়া গমন করে তার ব্যবসা এত সফলভাবে পরিচালনা করেন যে খাদিজা (রা.) প্রচণ্ডভাবে মুগ্ধ হন। তাঁর চরিত্র, সততা, বিনয়, বুদ্ধিমত্তা ও নেতৃত্বগুণে তিনি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন।
🟩 ৫ম অধ্যায়: রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে বিবাহ
ব্যবসার সফলতা ও মুহাম্মদ (সা.)-এর চরিত্রে আকৃষ্ট হয়ে খাদিজা (রা.) নিজেই বিয়ের প্রস্তাব দেন। সে যুগে একজন নারী হয়ে এমন সাহসী ও উচ্চস্তরের সিদ্ধান্ত খুব বিরল ছিল।
-
বিবাহের সময় খাদিজা (রা.)-এর বয়স ছিল ৪০, আর রাসূল (সা.)-এর বয়স ২৫
-
বিবাহ সম্পন্ন হয় কুরাইশের রীতি অনুযায়ী
-
রাসূল (সা.)-এর জীবদ্দশায় খাদিজা (রা.) ছিলেন একমাত্র স্ত্রী
এই দাম্পত্য জীবন ছিল ২৫ বছরের দীর্ঘ, যেখানে ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও সহযোগিতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়।
🟩 ৬ষ্ঠ অধ্যায়: দাম্পত্য জীবন ও পারিবারিক অবদান
খাদিজা (রা.) ছিলেন রাসূল (সা.)-এর জীবনের সবচেয়ে বড় অবলম্বন। নবুয়তের পূর্বেই তিনি রাসূল (সা.)-এর প্রতি অগাধ বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন এবং নবুয়তের পর তিনি রাসূল (সা.)-এর সবচেয়ে বড় সমর্থক ও সহচরী হয়ে ওঠেন।
-
গৃহকর্ম, মানবসেবা, দান, ইসলামের সহায়তা—সব কিছুতেই তিনি ছিলেন নিঃস্বার্থ
-
আর্থিকভাবে রাসূল (সা.)-কে শক্তিশালী করেন, যেন নবুয়তের দায়িত্ব পালনে তিনি বাধাহীন থাকেন
🟩 ৭ম অধ্যায়: ইসলাম গ্রহণ
খাদিজা (রা.) হলেন ইসলামের প্রথম বিশ্বাসী ব্যক্তি। হেরা গুহায় প্রথম ওহি লাভের পরে মুহাম্মদ (সা.) যখন ভীত ও উদ্বিগ্ন হয়ে ফিরে আসেন, তখন খাদিজা (রা.) তাঁকে শান্তনা দিয়ে বলেন:
“আল্লাহ কখনোই আপনাকে অপমান করবেন না। আপনি তো আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, দরিদ্রদের সাহায্য করেন, অতিথি আপ্যায়ন করেন, সত্যের পথে থাকেন।”
এরপর তিনি ওয়ারাকা ইবনে নওফলের সাথে নিয়ে যান — যিনি ঘোষণা করেন, “এ সেই ফেরেশতা, যিনি মূসার কাছে এসেছিলেন।”
এইভাবেই খাদিজা (রা.) হন প্রথম মুসলমান।
🟩 ৮ম অধ্যায়: সন্তানাদি
রাসূল (সা.) ও খাদিজা (রা.)-এর ছয়টি সন্তান হয়:
-
কাসিম – রাসূল (সা.)-এর কুনিয়াহ ছিল "আবুল কাসিম"
-
জাইনাব
-
রুকাইয়া
-
উম্মে কুলসুম
-
ফাতিমা (রা.) – ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ নারী, আলী (রা.)-এর স্ত্রী
-
আবদুল্লাহ (উপনাম: তাহির/তইয়্যিব)
➡️ দুই পুত্র ছোটবেলায় ইন্তেকাল করেন।
➡️ কন্যারা ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ইসলামী ইতিহাসে ভূমিকা রাখেন।
🟩 ৯ম অধ্যায়: ইসলামের পথে অবদান ও ত্যাগ
খাদিজা (রা.) নিজ ধন-সম্পদ রাসূল (সা.) ও সাহাবিদের জন্য ব্যয় করেন। তিনি ইসলাম প্রচারে আর্থিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে সাহস দেন। শিবা উপত্যকার বয়কটকালীন তিন বছর তিনি সকল কষ্ট ও অনাহার সহ্য করেন।
🟩 ১০ম অধ্যায়: ইন্তেকাল
খাদিজা (রা.) ৬১৯ খ্রিস্টাব্দে, রমজান মাসে ইন্তেকাল করেন। সে সময় তাঁর বয়স ছিল আনুমানিক ৬৫ বছর।
-
রাসূল (সা.) নিজ হাতে তাঁকে জান্নাতুল মু‘আল্লা কবরস্থানে দাফন করেন।
-
খাদিজা (রা.)-এর মৃত্যু ও চাচা আবু তালিবের মৃত্যুর ফলে রাসূল (সা.)-এর উপর দারুণ দুঃখ নেমে আসে।
-
রাসূল (সা.) সে বছরকে বলেন: “আমুল হুজন” — “দুঃখের বছর”
🟩 ১১তম অধ্যায়: মর্যাদা ও ফজিলত
রাসূল (সা.) বলেন:
“খাদিজা সেই নারী, যিনি আমাকে বিশ্বাস করেছিলেন যখন সবাই অস্বীকার করেছিল, আমাকে সাহায্য করেছিলেন যখন সবাই ত্যাগ করেছিল, তাঁর মাধ্যমে আমি সন্তান লাভ করেছি।”
📜 সহিহ বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত:
জিবরাঈল (আ.) রাসূল (সা.)-কে বলেন:
“তোমার স্ত্রী খাদিজার কাছে গিয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে সালাম পৌঁছে দাও এবং তাকে এমন জান্নাতের ঘরের শুভ সংবাদ দাও যেখানে শব্দ নেই, কষ্ট নেই।”
✅ উপসংহার
হজরত খাদিজা (রা.) হলেন ইসলামের ইতিহাসে নারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।
তিনি আদর্শ স্ত্রী, ব্যবসায়ী, মানবতাবাদী, ঈমানদার এবং ইসলাম প্রচারে সর্বপ্রথম শহীদ সমতুল্য অবদান রাখা এক মহীয়সী নারী। তাঁর জীবনী আমাদের প্রত্যেক নারী-পুরুষের জন্য পথপ্রদর্শক।
What's Your Reaction?






