হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) -এর জীবনী
হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) -এর জীবনী

হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) -এর জীবনী
প্রারম্ভিক পরিচয়:
হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ইসলামের সর্বপ্রথম খলিফা এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ঘনিষ্ঠতম সাহাবী। তাঁর আসল নাম ছিল আবদুল্লাহ ইবনে আবু কুহাফা আত-তাইমি আল-কুরাইশি। তিনি ৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দে, মক্কার অভিজাত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর উপনাম ছিল আবু বকর, আর রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁকে দিয়েছেন “সিদ্দিক” উপাধি, যার অর্থ—"সত্যবাদী"। এই উপাধি তিনি লাভ করেন রাসূল (সা.)-এর মিরাজের ঘটনাকে নির্দ্বিধায় সত্য বলে গ্রহণ করার জন্য।
ইসলাম গ্রহণ:
হজরত আবু বকর (রাঃ) ইসলামের প্রথমদিককার গ্রহণকারীদের অন্যতম। রাসূলুল্লাহ (সা.) নবুয়ত পাওয়ার পরে আবু বকর (রাঃ) সর্বপ্রথম প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ হিসেবে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ এবং জনমানসে অত্যন্ত সম্মানিত। তাঁর ইসলাম গ্রহণ অনেক মানুষের ইসলাম গ্রহণের পথ সুগম করে দেয়। তাঁর দাওয়াতের মাধ্যমে হজরত উসমান (রাঃ), আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ), তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ (রাঃ), জুবায়ের ইবনে আওয়াম (রাঃ) প্রমুখ সাহাবীগণ ইসলাম গ্রহণ করেন।
🌟 ইসলাম গ্রহণের ঘটনা:
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে নবুয়তপ্রাপ্ত হন (৬১০ খ্রিষ্টাব্দে), তখন তিনি প্রথমে তাঁর নিকট আত্মীয়দের মাঝে ইসলামের দাওয়াত দেন। সেই সময় হজরত আবু বকর (রাঃ) ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
রাসূল (সা.) যখন আবু বকর (রাঃ)-কে গোপনে ইসলাম সম্পর্কে বলেন, তখন তিনি বিনা দ্বিধায় তা গ্রহণ করেন। কোনো যুক্তি বা প্রশ্ন ছাড়াই তিনি ঈমান আনেন এবং বলেন:
"আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল।"
এইভাবে হজরত আবু বকর (রাঃ) প্রথম প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ হিসেবে ইসলাম গ্রহণ করেন।
📌 ইসলাম গ্রহণের পরবর্তী প্রভাব:
১. দাওয়াত ও সাহসী ভূমিকা
ইসলাম গ্রহণ করার সাথে সাথে তিনি দাওয়াতের কাজ শুরু করেন। তাঁর প্রভাব ও ব্যক্তিত্বের কারণে অনেক প্রভাবশালী মানুষ তাঁর মাধ্যমে ইসলাম গ্রহণ করেন, যেমন:
-
হজরত উসমান ইবনে আফফান (রাঃ)
-
হজরত তালহা (রাঃ)
-
হজরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ)
-
হজরত সাঈদ ইবনে যায়েদ (রাঃ)
-
হজরত জুবায়ের ইবনে আওয়াম (রাঃ)
এই সাহাবীরা পরবর্তীতে ইসলামি রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভে পরিণত হন।
২. অত্যাচারের বিরুদ্ধে অবস্থান
ইসলাম গ্রহণের পর মুসলিমদের ওপর কাফেররা চরম নির্যাতন শুরু করে। আবু বকর (রাঃ) নিজ অর্থ ব্যয় করে অনেক দাসকে মুক্ত করেন যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন:
-
হজরত বিলাল (রাঃ): যিনি ইসলাম গ্রহণের কারণে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হন।
আবু বকর (রাঃ) তাঁকে অনেক অর্থ দিয়ে কিনে নিয়ে মুক্ত করে দেন।
💡 তাঁর ইসলাম গ্রহণের তাৎপর্য:
✅ সাহসিকতা ও নির্ভরযোগ্যতা:
মক্কার সমাজে তাঁর মত একজন সম্মানিত ব্যক্তি যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন অন্যরাও ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। কারণ তাঁর সিদ্ধান্ত ও বিশ্বাস ছিল ন্যায়নিষ্ঠ ও সুপরিচিত।
✅ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য মানসিক শক্তি:
আবু বকর (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য ছিল এক বিশাল মানসিক শক্তির উৎস। তিনি শুরু থেকেই রাসূলের পাশে ছায়ার মতো ছিলেন।
✅ দাওয়াতের বেগবান প্রসার:
তাঁর দাওয়াত, দান, সেবা এবং উপস্থিতি ইসলামের গোড়ার দিকের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
✨ একটি বিশেষ ঘটনা:
ইসলাম গ্রহণের কয়েকদিন পর হজরত আবু বকর (রাঃ) চেয়েছিলেন জনসম্মুখে রাসূল (সা.)-এর বাণী প্রচার করতে। তিনি কাবা শরীফে গিয়ে ইসলামের বাণী প্রচার করলে কাফেররা তাঁর ওপর আক্রমণ করে এবং তাঁকে গুরুতর জখম করে। তাঁর আত্মীয়রা তাঁকে অচেতন অবস্থায় বাড়ি নিয়ে যায়। জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর প্রথম যে কথা তিনি বলেন তা ছিল:
"রাসূলুল্লাহ কেমন আছেন?"
এটি তাঁর ঈমানের গভীরতা ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসার এক উজ্জ্বল নিদর্শন।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ঘনিষ্ঠ সহচর:
আবু বকর (রাঃ) ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অন্তরঙ্গ বন্ধু, যিনি প্রতিটি বিপদে-আপদে তাঁকে সমর্থন করেছেন। হিজরতের সময় তিনি রাসূল (সা.)-এর সঙ্গী হিসেবে গুহা থাওরে আশ্রয় নেন। কুরআনের সূরা আত-তাওবা’র ৪০ নম্বর আয়াতে এই ঘটনার উল্লেখ আছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছিলেন, তখন আবু বকর (রাঃ) সবসময় পাশে ছিলেন।
হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ, বিশ্বস্ত ও প্রিয়তম সহচর। ইসলাম গ্রহণের শুরু থেকেই তিনি নবীজির পাশে ছিলেন, তাঁকে সর্বদা সহযোগিতা করেছেন এবং জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে তাঁর সঙ্গে থেকেছেন। তিনি প্রথম পূর্ণবয়স্ক পুরুষ হিসেবে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং কখনোই এতে কোনো সন্দেহ বা দ্বিধা প্রকাশ করেননি। মক্কায় কুরাইশদের নির্যাতনের সময়, তায়েফের বেদনার মুহূর্তে, হিজরতের রাতে—সবসময় তিনি ছিলেন নবীজির ছায়াসঙ্গী। বিশেষ করে হিজরতের সময়, তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর একমাত্র সঙ্গী; সেই বিখ্যাত সওর গুহাতে তিনিই নবীজির পাশে রাত কাটিয়েছিলেন। এ বিষয়ে কুরআনে বলা হয়েছে—
“যখন তারা উভয়ে গুহায় ছিল... তখন তিনি (নবী) তাঁর সঙ্গীকে বলছিলেন, ‘ভয় করো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’” (সূরা তাওবা, আয়াত ৪০)।
এই “সাহাবি”–অর্থাৎ সঙ্গী–শব্দটি এখানে আবু বকর (রাঃ)-এর জন্যই ব্যবহৃত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁকে সর্বদা ভালোবাসতেন, এমনকি ইন্তেকালের আগে বলেছিলেন, “আমার যদি দুনিয়াতে কোনো খলিল (ঘনিষ্ঠতম বন্ধু) থাকতো, তবে তা হতো আবু বকর।” তাঁদের এই সম্পর্ক কেবল রাজনৈতিক বা সামাজিক ছিল না, বরং ছিল আত্মিক, ঈমানি ও হৃদয়ের গভীরতা থেকে গড়া। আবু বকর (রাঃ) ছিলেন সেই সহচর, যিনি সবকিছু ত্যাগ করে রাসূলের সঙ্গে ছিলেন এবং যাঁকে নবীজির পাশে কবর দেওয়া হয়েছে। এটাই প্রমাণ করে, দুনিয়াতে যেমন তাঁরা একত্র ছিলেন, আখিরাতেও তেমনি তাঁদের সঙ্গ অনন্য ও চিরস্থায়ী।
“সিদ্দিক” উপাধির পেছনের ঘটনা:
ইসরা ও মিরাজের ঘটনা অনেকেই বিশ্বাস করতে কষ্ট পেয়েছিল। কিন্তু আবু বকর (রাঃ) বিনা প্রশ্নে মেনে নেন এবং বলেন, “যিনি আসমান থেকে অহী আনেন, তাঁর জন্য মিরাজে যাত্রা কোনো বড় বিষয় নয়।” এই অকুণ্ঠ বিশ্বাস ও সমর্থনের জন্য তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সা.) “সিদ্দিক” (সর্বাধিক সত্যনিষ্ঠ) উপাধি দেন।
হজরত আবু বকর (রাঃ) “সিদ্দিক” উপাধিতে ভূষিত হন তাঁর অকুণ্ঠ বিশ্বাস ও নির্ভরতার কারণে। এই উপাধির পেছনে রয়েছে এক মহান ঘটনা—মি’রাজের রাত্রি। যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেন যে তিনি এক রাতে মক্কা থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস হয়ে আকাশপথে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত গমন করে আবার ফিরে এসেছেন, তখন কুরাইশদের মধ্যে তীব্র অবিশ্বাস ও বিদ্রূপ শুরু হয়। তারা এই ঘটনাকে অবাস্তব ও অস্বাভাবিক মনে করে রাসূলকে মিথ্যাবাদী প্রমাণের চেষ্টা করে। এমন সময় তারা হজরত আবু বকরের (রাঃ) কাছে গিয়ে বলেন, “তোমার বন্ধু বলছে, সে এক রাতেই এতদূর গিয়েছে এবং ফিরে এসেছে—তুমি কি এতে বিশ্বাস করো?” তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে জবাব দেন: “যদি তিনি বলেছেন, তবে নিশ্চয়ই তা সত্য। আমি তো এমন অনেক কিছুতে বিশ্বাস করি যা তিনি আকাশ থেকে বলে থাকেন (অর্থাৎ ওহি)।” এই নিঃসংকোচ, নির্ভেজাল ও পূর্ণ আস্থাভরা উত্তরের পর রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁকে “আস্-সিদ্দিক”—অর্থাৎ “যিনি সর্বদা সত্যকে স্বীকার করেন”—উপাধিতে ভূষিত করেন। এই উপাধি তাঁর ঈমান, সত্যনিষ্ঠা ও রাসূলপ্রেমের অমর নিদর্শন হয়ে আজও ইতিহাসে অক্ষয়ভাবে জ্বলজ্বল করছে।
খিলাফত গ্রহণ:
৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর মুসলিম সমাজ শোকাহত অবস্থায় ছিল। এমন পরিস্থিতিতে হজরত আবু বকর (রাঃ) সাহাবীদের ঐক্যবদ্ধ করে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। সাহাবীরা সর্বসম্মতিক্রমে তাঁকে প্রথম খলিফা মনোনীত করেন। তাঁর খিলাফতের মেয়াদ ছিল প্রায় ২ বছর ৩ মাস।
🔶 ১. রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তিকালের পর সংকট
৬৩২ খ্রিস্টাব্দে (১১ হিজরি) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুর পর উম্মতের মধ্যে গভীর শোক নেমে আসে। অনেক সাহাবী বাকরুদ্ধ হয়ে যান, কেউ কেউ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এমনকি হজরত উমর (রাঃ) ঘোষণা করেন:
“যে বলবে মুহাম্মদ (সা.) মারা গেছেন, আমি তাকে তরবারি দিয়ে কেটে ফেলব।”
এই পরিস্থিতিতে হজরত আবু বকর (রাঃ) দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে সকলকে সম্বোধন করে বলেন:
"যে মুহাম্মদ (সা.)-কে উপাসনা করতো, জেনে রাখো তিনি ইন্তেকাল করেছেন। আর যে আল্লাহকে উপাসনা করতো, তিনি চিরঞ্জীব ও অমর।”
তারপর তিনি কুরআনের এই আয়াত তেলাওয়াত করেন:
"তুমি কি তবে মারা যাবে আর তারা পিছন ফিরে যাবে?..."
— (সূরা আলে ইমরান ৩:১৪৪)
এই ভাষণ সাহাবীদের মনে স্থিরতা ও নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করে।
🔶 ২. খিলাফতের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ইসলামী রাষ্ট্র একটি শূন্যতার মুখোমুখি হয়। মুসলিম সমাজের নেতৃত্ব ও ঐক্য বজায় রাখতে একজন স্থায়ী এবং স্বীকৃত নেতা বা খলিফার প্রয়োজন দেখা দেয়। সাহাবীরা তখন এই বিষয়ে পরামর্শ করতে শুরু করেন।
🔶 ৩. সাকিফা বনু সাঈদা সভা
আনসার ও মুহাজিরীন—এই দুই দল আলাদাভাবে নিজেদের খলিফা নির্বাচনের চিন্তা করছিল। আনসাররা সাকিফা নামক স্থানে একত্রিত হয়ে সা’দ ইবনে উবাদা (রাঃ)-কে নেতা নির্বাচনের প্রস্তাব করেন।
এ খবর পেয়ে হজরত আবু বকর (রাঃ), উমর (রাঃ) ও আবু উবাইদা (রাঃ) সেখানে ছুটে যান। আবু বকর (রাঃ) চমৎকার বক্তৃতা করে বলেন:
“নবী মুহাম্মদের (সা.) খিলাফতে কুরাইশই সবচেয়ে উপযুক্ত। কারণ তিনি কুরাইশ গোত্রভুক্ত।”
তিনি প্রস্তাব দেন—“তোমরা চাও, তবে উমর (রাঃ) অথবা আবু উবাইদা (রাঃ)-কে খলিফা হিসেবে গ্রহণ কর।”
তখন হজরত উমর (রাঃ) দাঁড়িয়ে বলেন:
“আবু বকর (রাঃ) আমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, যিনি মসজিদে রাসূলের ইমাম ছিলেন। আমরা কীভাবে এমন ব্যক্তির উপর অগ্রাধিকার দিব, যার ওপর রাসূল নিজে অগ্রাধিকার দিতেন?”
এরপর উমর (রাঃ) তাঁর হাতে বায়াত গ্রহণ করেন এবং উপস্থিত সকল সাহাবী তাঁকে খলিফা হিসেবে মেনে নেন।
🔶 ৪. সর্বসম্মত খিলাফত প্রতিষ্ঠা
পরদিন মসজিদে নববীতে আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলমানদের সামনে আবু বকর (রাঃ)-এর খিলাফতের ঘোষণা দেওয়া হয় এবং সাধারণ জনগণ তাঁর হাতে বায়াত গ্রহণ করে। এইভাবে ইসলামের ইতিহাসে প্রথম খলিফা হিসেবে হজরত আবু বকর (রাঃ)-এর আনুষ্ঠানিক খিলাফত শুরু হয়।
🔶 ৫. প্রথম খুতবা (নেতৃত্ব গ্রহণের ভাষণ)
হজরত আবু বকর (রাঃ) তাঁর খিলাফতের শুরুর ভাষণে বলেন:
“হে মানুষ! আমি তোমাদের উপর নেতা নিযুক্ত হয়েছি, অথচ আমি তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নই। যদি আমি সঠিক পথে চলি, তাহলে আমাকে অনুসরণ করো। যদি ভুল করি, তাহলে আমাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে দাও।... দুর্বলদের আমি শক্তিশালী করে দেব যতক্ষণ না তাদের হক আদায় হয়; আর শক্তিশালীদের আমি দুর্বল করে দেব যতক্ষণ না তারা হক ফেরত দেয়।...”
এই ভাষণ তাঁর বিনয়, দায়িত্ববোধ এবং সুবিচারের অঙ্গীকারের পরিচায়ক।
🔶 ৬. চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকূলতা
খিলাফত গ্রহণের পর হজরত আবু বকর (রাঃ)-এর সামনে কিছু গুরুতর চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়:
✅ মুরতাদ আন্দোলন (ধর্মত্যাগকারী সম্প্রদায়)
অনেক উপজাতি রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুর পর ইসলাম ত্যাগ করে, অনেকে যাকাত দেওয়া বন্ধ করে দেয়।
✅ মিথ্যা নবীদের উত্থান
মুসাইলিমা কাযযাব, তুলাইহা, ও সাজাহ নামক ব্যক্তিরা মিথ্যা নবুওয়তের দাবি করে বিদ্রোহ করে।
✅ অর্থনৈতিক সংকট
রাসূলের মৃত্যুতে প্রশাসনিক স্থবিরতা দেখা দেয়, যাকাত না আসায় রাজকোষে ঘাটতি দেখা দেয়।
হজরত আবু বকর (রাঃ) সাহসিকতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে এসব সমস্যার মোকাবিলা করেন। তিনি সেনাপতি খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রাঃ)-কে পাঠিয়ে বিদ্রোহ দমন করেন এবং ইয়ামামার যুদ্ধ-এ বিজয় লাভ করেন।
🔶 ৭. কুরআন সংকলনের নির্দেশ
যুদ্ধ-ই ইয়ামামায় বহু হাফেজ শহীদ হন। এই অবস্থায় হজরত ওমর (রাঃ)-এর পরামর্শে আবু বকর (রাঃ) সিদ্ধান্ত নেন—কুরআন মজীদকে লিখিত আকারে সংরক্ষণ করতে হবে। তিনি জাইদ ইবনে সাবিত (রাঃ)-কে এই দায়িত্ব দেন। এই ছিল কুরআনের প্রথম আনুষ্ঠানিক সংকলন।
শাসনকালীন কর্মকাণ্ড:
হজরত আবু বকর (রাঃ) তাঁর শাসনামলে ইসলামের ভিত্তিকে মজবুত করেন। রাসূলের ইন্তেকালের পর কিছু লোক ধর্মত্যাগ করে (মুরতাদ), কেউ কেউ নিজেকে নবী দাবি করে, আবার কেউ কেউ যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তিনি দৃঢ় হাতে এসব বিদ্রোহ দমন করেন।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য:
-
মুসাইলিমা কাযযাব নামে এক ব্যক্তি নবুয়তের দাবী করে। আবু বকর (রাঃ) তার বিরুদ্ধে সেনা পাঠান এবং যুদ্ধ-ই ইয়ামামা নামে বিখ্যাত যুদ্ধে মুসাইলিমার পরাজয় ঘটে।
-
এই যুদ্ধে বহু হাফেজ শহীদ হন, ফলে কুরআন সংকলনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। আবু বকর (রাঃ)-এর আদেশে সাহাবী জাইদ ইবনে সাবিত (রাঃ)-এর নেতৃত্বে পবিত্র কুরআন প্রথম লিখিতভাবে সংরক্ষণ করা হয়।
চরিত্র ও গুণাবলি:
আবু বকর (রাঃ) ছিলেন অত্যন্ত দানশীল, নম্র ও বিনয়ী। তাঁর জীবনে সম্পদের প্রতি আসক্তি ছিল না। তিনি বহু দাসকে মুক্ত করেছেন; যেমন – হজরত বিলাল (রাঃ)। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সমস্ত যুদ্ধে তিনি অংশ নিয়েছেন এবং সবসময় তাঁর পাশে থেকেছেন।
রাসূল (সা.) একাধিক হাদীসে বলেছেন:
“আবু বকর আমার উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম।”
“যদি আমি কাউকে খলিল (অন্তরঙ্গ বন্ধু) বানাতাম, তবে আবু বকরকেই বানাতাম।”
হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) ছিলেন এমন একজন মানুষ, যাঁর চরিত্র ও গুণাবলি ইসলামের ইতিহাসে অনন্য ও অতুলনীয়। তিনি ছিলেন বিনয়ী, নম্র, সৎ, সাহসী, দয়ালু এবং অত্যন্ত পরহেযগার। ইসলাম গ্রহণের পূর্বেও তিনি মক্কার সমাজে একজন বিশুদ্ধ চরিত্রের মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সত্যের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসাই তাঁকে “সিদ্দিক”—অর্থাৎ ‘যিনি সর্বদা সত্যকে সমর্থন করেন’—উপাধিতে ভূষিত করে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি তাঁর আনুগত্য ছিল নিঃশর্ত ও পূর্ণ বিশ্বাসভিত্তিক। তিনি কখনো অহংকার করতেন না, বরং নিজেকে সবসময় সাধারণ মুসলমানদের একজন হিসেবে ভাবতেন। খিলাফতের সময় তিনি অত্যন্ত সরল জীবনযাপন করতেন, এমনকি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ভাতা গ্রহণও অত্যন্ত সীমিত রাখতেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আপসহীন, অথচ ন্যায়পরায়ণতা ও ক্ষমার ক্ষেত্রে ছিলেন অতুলনীয়। তাঁর দানশীলতা ছিল বিস্ময়কর—ইসলামের প্রাথমিক যুগে প্রায় সব সম্পদই তিনি আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করেছিলেন। একইসাথে তিনি ছিলেন অশ্রুভেজা হৃদয়ের অধিকারী; কুরআন তিলাওয়াত করতে গিয়ে কাঁদতেন, নামাজে অশ্রুপাত করতেন। সাহাবায়ে কিরামের ভাষায়, তিনি ছিলেন এমন একজন নেতা, যিনি আল্লাহর ভয়কে সবকিছুর ওপরে স্থান দিতেন এবং যার প্রতিটি সিদ্ধান্তে থাকত ইখলাস ও সুবিবেচনার ছাপ। তাঁর চরিত্র ছিল রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শের এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি—একজন প্রকৃত মু’মিন, যিনি নিজের জীবনকে সম্পূর্ণভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের খিদমতে উৎসর্গ করেছিলেন।
ইন্তেকাল ও দাফন:
হজরত আবু বকর (রাঃ) ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে জমাদিউস সানি তারিখে, ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর আগে তিনি নিজ হাতে হজরত উমর (রাঃ)-কে পরবর্তী খলিফা নিযুক্ত করেন। তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পাশেই দাফন করা হয় – মসজিদে নববীর অভ্যন্তরে।
হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) ইসলামের প্রথম খলিফা হিসেবে মাত্র দুই বছর তিন মাস দায়িত্ব পালন করার পর ১৩ হিজরি সনের ২২ জমাদিউস্সানি সোমবার দিন ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল ৬৩ বছর, যা ছিল রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বয়সের সমান। অসুস্থতার শুরু হয়েছিল ঠান্ডা লাগা থেকে, যা পরবর্তীতে জ্বর ও শারীরিক দুর্বলতায় রূপ নেয়। অসুস্থ অবস্থায় তিনি উম্মতের ভবিষ্যতের কথা ভেবে হজরত উমর (রাঃ)-কে তাঁর পরবর্তী খলিফা হিসেবে মনোনয়ন দেন এবং উম্মাহর সম্মতিক্রমে তা নিশ্চিত করেন। মৃত্যুর সময় তাঁর কণ্ঠে ছিল আল্লাহর প্রতি পূর্ণ নির্ভরতার প্রার্থনা: “হে আল্লাহ! আমাকে মুসলমান অবস্থায় মৃত্যু দাও এবং সৎকর্মীদের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করো।” তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নেন অত্যন্ত শান্ত ও ঈমানদীপ্ত হৃদয়ে। তাঁর জানাজার নামাজ মসজিদে নববীতে অনুষ্ঠিত হয়, এবং অনেক সাহাবী উপস্থিত ছিলেন। ওসিয়ত অনুযায়ী তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ডান পাশে, হজরত আয়েশা (রাঃ)-এর ঘরের ভিতরে দাফন করা হয়, যা পরবর্তীতে মসজিদের অন্তর্ভুক্ত হয়। তাঁর এই দাফন প্রমাণ করে, দুনিয়া ও আখিরাতে তিনি নবীজি (সা.)-এর ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে উম্মতের মাঝে গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে এবং সাহাবীরা বলেছিলেন: “আজ উম্মতের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বিদায় নিলেন।”
উপসংহার:
হজরত আবু বকর (রাঃ)-এর জীবন ছিল কুরআন ও রাসূলের আদর্শে গঠিত এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। তিনি ইসলামের ভিতকে সংহত করেছেন, সাহাবীদের ঐক্যবদ্ধ করেছেন এবং ইসলামী রাষ্ট্রকে প্রথম সুসংবদ্ধ কাঠামোতে রূপ দিয়েছেন। তিনি সকল খলিফাদের জন্য একটি অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে আছেন।
What's Your Reaction?






