রাজা রামমোহন রায় এর জীবনী
রাজা রামমোহন রায়,জীবনী

বিষয় | বিস্তারিত |
---|---|
পূর্ণ নাম | রাজা রামমোহন রায় (Raja Ram Mohan Roy) |
জন্ম তারিখ | ২২ মে ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দ |
জন্মস্থান | রadhanagar, মুর্শিদাবাদ, বাংলার (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) |
পিতা | রামকৃষ্ণ রায় |
মাতা | ভূমি ডেবী |
শিক্ষা | বাংলা, সংস্কৃত, আরবি, ফার্সি, ইংরেজি ও হিন্দু দর্শন সম্পর্কে অধ্যয়ন |
পেশা | সমাজ সংস্কারক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক |
প্রধান অবদান | ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা, সতির নিষেধ আইন, হিন্দু ধর্মে সংস্কার |
মৃত্যু | ২৭ সেপ্টেম্বর ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দ |
মৃত্যুর স্থান | ব্রিটিশ ভারত, ইংল্যান্ড (ব্রিস্টল) |
মৃত্যুর কারণ | জ্বর ও শারীরিক অসুস্থতা |
উত্তরাধিকার | ব্রাহ্ম সমাজ, নারী শিক্ষার প্রচার, সমাজ সংস্কারের উদ্যোগ |
রাজা রামমোহন রায় ছিলেন ভারতীয় সমাজ সংস্কারক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাতা। তাকে "সমাজ সংস্কারের প্রথম যোদ্ধা" এবং "মর্ডান ভারতীয় সংস্কৃতির পিতা" হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তার জীবন ও কাজ ভারতীয় সমাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বিশেষ করে তার বিশাল সমাজ সংস্কারের উদ্যোগের জন্য, যা ভারতীয় সংস্কৃতি এবং সমাজকে আধুনিকতার দিকে নিয়ে গিয়েছিল।
শৈশব ও শিক্ষাজীবন:
রাজা রামমোহন রায় ১৭৭২ সালের ২২ মে মুর্শিদাবাদ জেলার রাধানগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একটি উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ পরিবার থেকে। তার পিতা রামকৃষ্ণ রায় ছিলেন একজন উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, এবং তার মাতা ভূমি ডেবী ছিলেন এক আদর্শ এবং সজ্জন নারী। রামমোহনের শৈশব কাটে সংস্কৃত, আরবি, ফার্সি, হিন্দু দর্শন ও গ্রন্থগুলোর সাথে পরিচিত হয়ে, এবং তিনি এই ভাষাগুলির গভীর জ্ঞান লাভ করেন।
তার শৈশব থেকে শিক্ষার প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল এবং তিনি বিভিন্ন ধর্ম ও দর্শন সম্পর্কে অধ্যয়ন করতে শুরু করেন। বিশেষভাবে, তিনি ইংরেজি ভাষা শিখে ব্রিটিশ শিক্ষার ব্যাপারে আগ্রহী হন এবং আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের প্রতি আগ্রহী ছিলেন।
সমাজ সংস্কারে অবদান:
রাজা রামমোহন রায় একজন গুরুত্বপূর্ণ সমাজ সংস্কারক ছিলেন, এবং তার কার্যক্রম ভারতীয় সমাজকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে সহায়তা করেছিল। তার মূল লক্ষ্য ছিল ধর্মীয় কুসংস্কার, সামাজিক অশান্তি ও নারী নির্যাতন এর বিরুদ্ধে লড়াই করা।
১. ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা:
রাজা রামমোহন রায় ১৮২৮ সালে ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন, যা হিন্দু ধর্মের সংস্কারক হিসেবে আবির্ভূত হয়। এটি ছিল এক আধুনিক ও বৈষম্যহীন ধর্মীয় সম্প্রদায়, যেখানে পূজারী শ্রেণী বা ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা হতো। ব্রাহ্ম সমাজের উদ্দেশ্য ছিল ধর্মীয় ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা এবং ভারতীয় সমাজে সাম্য, সমবেদনা এবং সহিষ্ণুতার মূলনীতি প্রচার করা।
২. সতির নিষেধ (Sati Abolition):
রাজা রামমোহন রায় একজন দৃঢ় সমর্থক ছিলেন সতির নিষেধ আন্দোলনের। ১৮২৯ সালে তার প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ সরকার সতির প্রথা নিষিদ্ধ করে। এই প্রথা ছিল যে, স্বামী মৃত্যুর পর স্ত্রীরা নিজেকে তার দেহের পাশে জীবন্ত পুড়িয়ে মারত। রামমোহন রায় এই প্রথার কঠোর বিরোধিতা করেছিলেন এবং তার প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ সরকার এই অমানবিক প্রথাটি নিষিদ্ধ করে।
৩. নারী শিক্ষার প্রচার:
রাজা রামমোহন রায় নারী শিক্ষার প্রচারক ছিলেন। তার প্রচেষ্টায় কলকাতায় প্রথম মহিলা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি নারীশিক্ষার গুরুত্ব ও সমতা সম্পর্কে অনেক প্রচারণা চালিয়েছিলেন। রামমোহন রায় বিশ্বাস করতেন যে, নারীদের উন্নয়ন ছাড়া কোনও সমাজ উন্নতি লাভ করতে পারে না।
৪. ধর্মীয় সংস্কার ও সংস্কৃতির পুনর্গঠন:
রাজা রামমোহন রায় হিন্দু ধর্মের পুরনো রীতিনীতি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ছিল। তিনি বেদ ও উপনিষদ এর মূল চেতনায় ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। তার মতে, ধর্মের মূল উদ্দেশ্য মানুষের নৈতিক উন্নয়ন, এবং তিনি আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও মানবতাবাদকে উত্সাহিত করতে চাইতেন।
রাজনৈতিক জীবন ও ইংল্যান্ডে জীবন:
রাজা রামমোহন রায় ইংল্যান্ডের সংস্কৃতি ও দর্শনেও গভীর আগ্রহী ছিলেন। তিনি ইংল্যান্ডে গিয়ে আধুনিক শিক্ষা ও রাজনীতি সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ইংল্যান্ডের ব্রিটিশ প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন এবং সেখানকার সংস্কৃতি ও আইন নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। রামমোহন রায় ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে পাশ্চাত্য চিন্তা-ধারার মেলবন্ধন ঘটাতে চেয়েছিলেন।
মৃত্যু:
রাজা রামমোহন রায় ১৮৩৩ সালে ইংল্যান্ডে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি সেখানেই শেষ জীবনের কয়েকটি বছর কাটিয়েছিলেন, এবং সেখানকার শারীরিক অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে ২৭ সেপ্টেম্বর ১৮৩৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর, তার কার্যক্রম ভারতীয় সমাজে গভীর প্রভাব রেখে যায় এবং তিনি একটি সশক্ত সমাজের প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখেন।
উত্তরাধিকার:
রাজা রামমোহন রায়ের কাজ ও অবদান আজও ভারতের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার উদ্যোগের ফলে ভারতের সমাজ ও সংস্কৃতি বড় পরিবর্তন দেখেছিল। ব্রাহ্ম সমাজ এবং তার ধর্মীয় সংস্কারের উদ্যোগ মুসলিম ও হিন্দু ধর্মে সামাজিক সমতার প্রচার করেছিল। তার পরবর্তীকালে বহু সমাজ সংস্কারক, যেমন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও দীনানাথ ঠাকুর, তার আদর্শ অনুসরণ করেছিলেন।
রাজা রামমোহন রায়ের অবদান শুধু ভারতীয় সমাজ নয়, পুরো পৃথিবীকে মানবাধিকার, সমাজসেবা, নারী অধিকারের প্রতি এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছে।
What's Your Reaction?






