হযরত আবদুল কাদির জিলানী (রহঃ) এর পূর্ণাঙ্গ জীবনী
হযরত আবদুল কাদির জিলানী (রহঃ) এর পূর্ণাঙ্গ জীবনী

বিষয় | তথ্য |
---|---|
পূর্ণ নাম | আবু মুহাম্মদ মুহিউদ্দীন আবদুল কাদির আল-জিলানী (রহঃ) |
উপাধি | গাউসুল আজম, শাইখুল ইসলাম, সুলতানুল আওলিয়া |
জন্ম তারিখ | ১ রমজান, ৪৭০ হিজরি / ১০৭৭ খ্রিষ্টাব্দ |
জন্মস্থান | জিলান (গিলান), পারস্য (বর্তমান ইরান) |
মৃত্যু তারিখ | ১১ রবিউস সানি, ৫৬১ হিজরি / ১১৬৬ খ্রিষ্টাব্দ |
মৃত্যুস্থান | বাগদাদ, ইরাক |
মাযহাব | হাম্বলি |
তরিকাহ | কাদেরিয়া (Qadiriyya) তরিকা |
সমাধিস্থল | বাব-আয-জওয়ান, বাগদাদ, ইরাক |
🔹 নাম ও বংশপরিচয়:
হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহঃ)-এর পূর্ণ নাম ছিল আবু মুহাম্মদ মুহিউদ্দিন আব্দুল কাদির বিন আবু সালেহ মুসা আল-জিলানী। তিনি ছিলেন এক সম্মানিত সাইয়্যেদ বংশের সন্তান, যাঁর বংশধারা হযরত আলী (রাঃ) ও হযরত ফাতিমা (রাঃ)-এর মাধ্যমে সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছে। তাঁর পিতার নাম ছিল আবু সালেহ মুসা জংগি দোস্ত, যিনি একজন পরহেজগার, আল্লাহভীরু ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর মাতা ছিলেন ফাতিমা বিনতে আব্দুল্লাহ, যিনি নিজেও অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ও সৎচারিত্রিক নারী ছিলেন। বলা হয়ে থাকে, তিনি গর্ভকালীন সময় থেকেই ছেলেকে হালাল খাদ্যে লালন করতেন এবং রমজানে আব্দুল কাদির (রহঃ) তখনও মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় রোজা রেখেছিলেন – এমন অলৌকিক ঘটনাও ইতিহাসে উল্লেখ আছে।
হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহঃ) ৪৭১ হিজরি, ১ রমজান (মতান্তরে ১০৭৮ খ্রিস্টাব্দ) ইরানের গিলান (জিলান) নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। সে সময় অঞ্চলটি পারস্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। জন্মস্থান অনুযায়ী তাঁর নামের শেষে “আল-জিলানী” যোগ হয়েছে। জীবনের পরিণত সময়ে তিনি বাগদাদে গিয়ে ইলম হাসিল করেন ও ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন এবং সেখানেই ৫৬১ হিজরি, ১১ রবিউস সানি (১১৬৬ খ্রিস্টাব্দ)-তে ইন্তেকাল করেন। তাঁর বংশধারা ও বংশগৌরব তাঁকে কেবল রক্তসূত্রে মহান করেনি, বরং তিনি নিজ গুণে ও আত্মিক সাধনায় ইসলামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রে পরিণত হন।
🔹 শৈশব ও শিক্ষা জীবন:
হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহঃ) ছোটবেলা থেকেই ধর্মপ্রাণ, ভদ্র ও ধ্যানমগ্ন ছিলেন। তাঁর মা অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ছিলেন এবং ছেলেকে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করেছিলেন।
১৫ বছর বয়সে তিনি শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে বাগদাদে যান। সেখানকার বিখ্যাত মাদরাসা ‘জামিয়া নিজামিয়া’-তে তিনি হাদিস, তাফসির, ফিকহ, ও সুফিবাদে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন। তাঁর শিক্ষকগণ ছিলেন:
হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহঃ) শৈশব থেকেই ছিলেন অত্যন্ত নম্র, বিনয়ী, শান্ত ও ধর্মপ্রাণ। তিনি ছোটবেলা থেকেই আল্লাহভীরু ছিলেন এবং কখনো মিথ্যা কথা বলতেন না। তাঁর মাতা ছিলেন একজন পরহেজগার ও দীনদার নারী, যিনি সন্তানকে হালাল খাদ্য খাওয়াতেন এবং ছোটবেলা থেকেই তাঁকে আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর শৈশবের অনেক অলৌকিক ঘটনা ইতিহাসে উল্লেখ আছে। বলা হয়ে থাকে, একবার তিনি শিশু বয়সে খেলতে খেলতে এমন কিছু জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিলেন যেখানে শুধু পরহেজগার ব্যক্তিরাই জিকির করতেন, আর তিনি তাদের সঙ্গে বসে চুপচাপ থাকতেন। এতে তাঁর আত্মিক মেধা ও ধ্যানমগ্ন স্বভাবের প্রমাণ পাওয়া যায়।
১৫ বছর বয়সে তিনি জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে মা’এর অনুমতি নিয়ে গিলান থেকে বের হয়ে দীর্ঘ সফরের পর ইরাকের বাগদাদ শহরে পৌঁছান। বাগদাদ সে সময় জ্ঞান ও সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্র ছিল। তিনি সেখানে জামিয়া নিজামিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন, যা ছিল সে সময়কার সবচেয়ে বড় ও সম্মানিত ইসলামি বিদ্যাপীঠ। তিনি এখানে তাফসির, হাদীস, ফিকহ, নাহু, সারফ, সাহিত্য ও যুক্তিবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে অগাধ জ্ঞান অর্জন করেন। ফিকহ শাস্ত্রে তিনি হানাবলি মাজহাব অনুসরণ করতেন, কিন্তু অন্য মাজহাব সম্পর্কেও তাঁর ছিল সুগভীর জ্ঞান। তাঁর অন্যতম প্রধান শিক্ষক ছিলেন আবু সাঈদ মাখরুমি, যিনি তাঁর আত্মিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির পথপ্রদর্শক ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি ইমাম আবু বকর ইবন মুজাহিদ, ইবনে আকীল প্রমুখ বড় বড় আলেমদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন।
তাঁর প্রতিভা ও মনোযোগ এতই প্রখর ছিল যে অল্প সময়েই তিনি বাগদাদে জ্ঞানের ক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জন করেন। কিন্তু তিনি শুধু বিদ্যা অর্জন করেই ক্ষান্ত হননি—বরং জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার সমন্বয়ে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন এক পূর্ণ মানব হিসেব
🔹 আধ্যাত্মিক সাধনা:
হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহঃ)-এর আধ্যাত্মিক সাধনা ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা তাঁকে কেবল একজন জ্ঞানী আলেম নয়, বরং এক পরিপূর্ণ আধ্যাত্মিক সাধক ও আল্লাহপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তোলে। শিক্ষা লাভ শেষে তিনি নিজেকে দুনিয়াবি চাকচিক্য ও মোহ থেকে দূরে রেখে আত্মশুদ্ধির কঠিন পথ বেছে নেন। বাগদাদের বাইরের মরুভূমি, পাহাড়, গুহা এবং নির্জন বনভূমিতে তিনি দীর্ঘ ২৫ বছর কাটান কঠোর তপস্যা, ধ্যান ও মুজাহিদার (আত্মসংযম ও সাধনা) মধ্য দিয়ে। এই সময়ে তিনি প্রায়ই উপবাস থাকতেন, নিঃসঙ্গতার মধ্যে রাত কাটাতেন, এবং আল্লাহর ধ্যানে বিভোর থাকতেন।
তাঁর সাধনার মূল লক্ষ্য ছিল আল্লাহর ঘনিষ্ঠতা (কুরবত) অর্জন এবং নিজের অন্তরকে সকল প্রকার দুনিয়াবি চাহিদা ও মোহ থেকে পরিশুদ্ধ করা। বলা হয়ে থাকে, তিনি এমন এক সময় পার করেছিলেন যখন দিনের পর দিন কিছু না খেয়েও তিনি কেবল আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকতেন। তাঁর ধ্যান, মোনাজাত ও ইবাদতের দৃঢ়তা এমন ছিল যে, জ্বিন ও শয়তান পর্যন্ত তাঁর ওপর প্রভাব ফেলতে পারত না। শয়তান বহুবার বিভিন্ন রূপে এসে তাঁকে পথভ্রষ্ট করতে চেয়েছে, কিন্তু প্রতিবার তিনি নিজ ঈমান ও অন্তরের শক্তি দিয়ে তা প্রতিহত করেছেন।
একবার শয়তান তাঁর কাছে একটি আলোর গোলা আকারে এসে বলেছিল, “হে আব্দুল কাদির! আমি তোমার রব। আমি তোমার ওপর থেকে ইবাদতের দায়িত্ব তুলে নিয়েছি।” কিন্তু হযরত সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারেন এটি শয়তানের ধোঁকা। তিনি জবাব দেন, “ও দূর হ, তুমি আমার রব হতে পারো না, কারণ আমার রব এমন কিছু আদেশ দিবেন না যা শরিয়তের বিরুদ্ধ।” তখন সেই আলোর গোলাটি অদৃশ্য হয়ে যায় এবং কণ্ঠ ভেসে আসে, “তুমি তোমার ইলম ও তাওফিকের মাধ্যমে রক্ষা পেয়েছো।”
এই ঘটনার মাধ্যমে বোঝা যায় যে, হযরতের আধ্যাত্মিক শক্তি শুধু মুজাহিদায় অর্জিত নয়, বরং তিনি ইলম ও হিকমতের সমন্বয়ে সত্যিকারের ভক্তি ও আল্লাহর প্রেম লাভ করেছিলেন। তাঁর এই কঠোর আত্মসাধনা ও নিঃস্বার্থ পরিশ্রমই তাঁকে এমন এক আধ্যাত্মিক উচ্চতায় পৌঁছে দেয়, যেখান থেকে তিনি পরবর্তী সময়ে লাখ লাখ মানুষের আত্মার ডাক শুনে তাদের পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠেন।
আধ্যাত্মিক সাধনার এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পর, তিনি যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ প্রাপ্ত হন, তখন তিনি জনসমক্ষে এসে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ শুরু করেন। তখন বাগদাদের মসজিদগুলো, দরসগাহ ও খানকাগুলো তাঁর মুখ নিঃসৃত জ্ঞান ও নুরে উদ্ভাসিত হতে থাকে। তাঁর এই আধ্যাত্মিক সাধনাই পরবর্তী সময়ে তাঁকে গাউসুল আজম (সর্বোচ্চ সাহায্যকারী) উপাধিতে ভূষিত করে।
🔹 শিক্ষা ও দাওয়াত:
তিনি বাগদাদের এক বিখ্যাত মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। তাঁর বক্তব্য ছিল হৃদয়স্পর্শী ও যুক্তিবহুল। তাঁর শিক্ষার মূল বিষয়গুলো ছিল:
-
কুরআন ও হাদিসভিত্তিক ইসলামী জীবন
-
তাওহিদ (আল্লাহর একত্ববাদ)
-
আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়া
-
দুনিয়া বিমুখতা ও আখিরাত মুখিনতা
তিনি প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষকে উপদেশ দিতেন। তাঁর মাহফিলে অনেক খ্রিষ্টান ও ইহুদি ইসলাম গ্রহণ করেন।
আধ্যাত্মিক সাধনার দীর্ঘ সময় অতিক্রম করার পর হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহঃ) আল্লাহর আদেশে জনসমক্ষে আসেন এবং মানুষের আত্মিক ও নৈতিক উন্নয়নের জন্য দাওয়াতের কার্যক্রম শুরু করেন। তিনি বাগদাদের বিখ্যাত মসজিদ ও মাদরাসাগুলিতে ইসলামি শিক্ষা প্রদান শুরু করেন এবং অল্প সময়েই এক অসাধারণ খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর বক্তৃতা ছিল হৃদয়গ্রাহী, যুক্তিপূর্ণ এবং আত্মা-উদ্বুদ্ধকারী। হাজার হাজার মানুষ তাঁর দরসে অংশ নিতেন—তাঁদের মধ্যে ছিলেন আলেম, মুফতি, ছাত্র, সাধারণ মানুষ এমনকি অন্য ধর্মের অনুসারীরাও।
তাঁর শিক্ষা ছিল কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক এবং সর্বদা সত্যের পক্ষে। তিনি শুধু ফিকহ বা হাদিস শেখাতেন না; বরং মানুষকে আত্মশুদ্ধি, নৈতিকতা, ইখলাস (নিষ্ঠা), তাকওয়া (আল্লাহভীতি), এবং আল্লাহর প্রতি গভীর ভালোবাসা শেখাতেন। তিনি দুনিয়াবি মোহ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিতেন এবং পরকালের জন্য প্রস্তুত থাকার গুরুত্ব বুঝাতেন। তাঁর বক্তব্য ছিল এমন—যা মানুষকে কাঁদিয়ে দিত, আত্মোপলব্ধি জাগ্রত করত এবং আমূল পরিবর্তনের পথ দেখাত।
তাঁর দাওয়াতি কাজের প্রভাবে বহু বিপথগামী ব্যক্তি সৎপথে ফিরে আসে, বহু অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করে এবং অনেক উচ্চপদস্থ ব্যক্তি তাঁদের দম্ভ ও অহংকার ত্যাগ করে বিনম্র হয়ে যায়। তিনি সর্বদা বলতেন, “সত্যকে গ্রহণ করো, মিথ্যার সঙ্গে আপস করো না; আর আল্লাহর প্রেমে আত্মা ডুবিয়ে দাও।”
তাঁর দাওয়াতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল এটি—তিনি কেবল জ্ঞান বিতরণ করতেন না, বরং সেই জ্ঞানকে জীবনে বাস্তবায়নের পথ দেখাতেন। তাঁর শিক্ষা মানুষকে আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করতে উৎসাহিত করত। তাঁর দরসে আসা লোকেরা শুধু একটি ক্লাসের অংশগ্রহণকারী নয়, বরং তারা হয়ে উঠত পথের যাত্রী—যারা ইলম ও তাসাউফের মিশ্রণে পরিপূর্ণ জীবনের সন্ধান পেত।
এইভাবেই হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহঃ) শিক্ষা ও দাওয়াতের মাধ্যমে শুধু বাগদাদ নয়, বরং সমগ্র মুসলিম বিশ্বে তাঁর প্রভাব বিস্তার করেন এবং ইসলামের আধ্যাত্মিক জাগরণে এক অমর অবদান রাখেন।
🔹 তরিকতের প্রচার:
তিনি ছিলেন কাদিরিয়া তরিকার প্রবর্তক। এই তরিকায় মানুষ আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় শিখে।
কাদিরিয়া তরিকার মূলনীতিগুলো:
-
জিকির
-
ইখলাস
-
খালিস তাওহিদ
-
মুরিদ ও মুর্শিদের সম্পর্ক
হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহঃ) ছিলেন তাসাউফ তথা আধ্যাত্মিক জীবনের এক মহান পথপ্রদর্শক। তিনি ইসলামের অন্তর্নিহিত আত্মিক দিক—তরিকত—এর বিকাশ ও প্রচারে অসামান্য ভূমিকা পালন করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সুফি তরিকা, যা “কাদিরিয়া তরিকা” নামে খ্যাত, মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রধান ও সর্বাধিক বিস্তৃত তরিকায় পরিণত হয়। এই তরিকার মূল ভিত্তি ছিল কুরআন ও সুন্নাহ অনুসারে জীবন গঠন, আত্মশুদ্ধি, আল্লাহভীতি, নিঃস্বার্থতা, ইখলাস (নিষ্ঠা), এবং মানুষের খেদমত করা।
তিনি তাঁর মজলিসে (ধর্মীয় সমাবেশ) এমনভাবে জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতা একত্রে উপস্থাপন করতেন, যা উপস্থিত ব্যক্তিদের হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করত। তাঁর দরসে শুধু ইসলামী আইন বা দর্শন শেখানো হতো না, বরং একজন মুমিন কীভাবে আত্মিক পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করবে, সেই পথও দেখানো হতো। তিনি মানুষকে শিখাতেন—“যে নিজেকে চিনে, সে-ই তার প্রভুকে চিনে,” অর্থাৎ আত্মচর্চার মাধ্যমেই একজন মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে।
তাঁর তরিকার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষা—যেখানে শরিয়াহ (আইন) এবং হাকিকাহ (আত্মিক সত্য) ছিল একে অপরের পরিপূরক। তিনি কোনো চরমপন্থা বা অতিরঞ্জনের পথে হাঁটেননি। বরং তিনি প্রতিটি মানুষের ইমানি শক্তিকে জাগিয়ে তুলতেন এবং তাদেরকে সঠিক পথে চলার জন্য বাস্তব ও আধ্যাত্মিক দিক থেকে প্রস্তুত করতেন।
কাদিরিয়া তরিকা তাঁর ছাত্র ও অনুসারীদের মাধ্যমে শুধু ইরাক নয়, আরব, পারস্য, ভারত, আফ্রিকা এবং পরে উপমহাদেশেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এই তরিকার মাধ্যমে লাখো মানুষ ইসলামের মূল শিক্ষা—আল্লাহর একত্ব, নবুয়তের অনুসরণ ও নৈতিক পরিশুদ্ধি—কে গ্রহণ করে। হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহঃ) নিজেই বলেন, “আমার পা সকল অলিয়াগণের কাঁধের উপর,” অর্থাৎ তাঁর অনুসৃত তরিকায় এমন এক আধ্যাত্মিক উচ্চতা রয়েছে যা বিশ্বসুন্দর আত্মাগণের দিকনির্দেশক।
তাঁর এই তরিকত আজও বিশ্বব্যাপী জীবন্ত এবং কোটি কোটি অনুসারী তাঁর দেখানো পথে আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্যের সাধনা করে যাচ্ছেন।
🔹 মুজিজা (কারামত):
হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহঃ)-এর বহু কারামতের কথা ইতিহাসে উল্লেখ আছে। তার কিছু প্রসিদ্ধ কারামত:
-
দূর থেকে মানুষের অবস্থা জেনে ফেলা
-
দোয়ার মাধ্যমে রোগ নিরাময়
-
জ্বিন ও শয়তানের আক্রমণ থেকে মানুষকে রক্ষা করা
-
বিপদে সাহায্য পাওয়া (“গাউসে আজম ইয়াগিসনী” ডাক দিলে সাহায্য আসা)
হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহঃ) ছিলেন এমন একজন আধ্যাত্মিক সাধক, যাঁর জীবন ও কর্মের মাধ্যমে অসংখ্য কারামত বা অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, কারামত হলো আউলিয়াদের (আল্লাহর নিকটবর্তী বান্দা) হাতে প্রকাশিত অসাধারণ ঘটনা, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের প্রতি সম্মান ও সহায়তার নিদর্শন হিসেবে প্রকাশিত হয়। হযরত জিলানী (রহঃ)-এর জীবনে এত বেশি কারামত সংঘটিত হয়েছে যে তিনি "গাউসুল আজম" বা "সর্বোচ্চ সাহায্যকারী" উপাধিতে ভূষিত হন।
তাঁর একটি বিখ্যাত কারামত হলো—যখন একবার শয়তান আলোর গোলা আকারে এসে তাঁকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল এবং বলেছিল, “আমি তোমার রব, আমি তোমার ওপর থেকে ইবাদতের দায়িত্ব তুলে নিয়েছি।” হযরত তখন সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেলেন এটি শয়তানের ধোঁকা এবং জবাব দেন, “চুপ কর! তুমি আমার রব হতে পারো না। আমার রব কখনো শরিয়তের বিরুদ্ধ কোনো আদেশ দিবেন না।” তখন সেই আলো অদৃশ্য হয়ে যায় এবং কণ্ঠ ভেসে আসে: “হে আব্দুল কাদির! তুমি তোমার জ্ঞান এবং সততার মাধ্যমে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছো।” এই ঘটনা তাঁর গভীর ইলম, বুদ্ধিমত্তা ও আধ্যাত্মিক বিচক্ষণতার প্রমাণ বহন করে।
আরও অনেক কারামতের বর্ণনা ইতিহাসে পাওয়া যায়। যেমন—অনেক সময় মানুষ বহু দুর থেকে এসে তাঁর দরবারে পৌঁছানোর আগেই তিনি তাদের নাম, উদ্দেশ্য এবং সমস্যা বলে দিতেন। কেউ কেউ বর্ণনা করেন, তাঁকে দূর থেকে ডাক দিলে বা তাঁর নাম নিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করলে, তাৎক্ষণিকভাবে তিনি তাদের পাশে হাজির হয়ে যেতেন এবং বিপদ থেকে উদ্ধার করতেন। এমনকি অনেকে বলেন, তাঁর দোয়ায় মৃত ব্যক্তিও জীবিত হয়ে উঠেছিল, কিংবা দুরারোগ্য রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করেছিল।
একবার এক ব্যক্তি দুর্বল ঘোড়ায় চড়ে বাগদাদের দিকে রওনা হন হযরতের সাক্ষাৎ পাওয়ার আশায়। কিন্তু পথে তাঁর ঘোড়া ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তিনি তখন আকুল হয়ে বলেন, “হে গাউসুল আজম! আমার ঘোড়াটিকে সাহায্য করুন।” সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়াটি সজীব হয়ে উঠে দৌড়াতে শুরু করে এবং সময়মতো তাকে দরবারে পৌঁছে দেয়।
এই ধরনের কারামত তাঁর আধ্যাত্মিক উচ্চতা, আল্লাহর নৈকট্য এবং দুনিয়া ও আখিরাতের উপর তাঁর প্রভাবের একটি নিদর্শন। তবে হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহঃ) নিজে কখনো তাঁর কারামতের গর্ব করতেন না। বরং তিনি সবসময় মানুষকে আল্লাহর দিকে ফিরে আসতে বলতেন এবং তাঁদের বুঝাতেন যে, এসব কিছুই আল্লাহর কৃপা ছাড়া সম্ভব নয়। তাঁর শিক্ষা ছিল স্পষ্ট—কারামতের পেছনে দৌড়ানো নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই মুমিনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।
🔹 মৃত্যু ও ওফাত:
৫৬১ হিজরি, ১১ রবিউস সানি তারিখে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর ওফাত দিবসটি বিশ্বব্যাপী “গাউসুল আজমের উরস” নামে পালিত হয়।
হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহঃ) সারাজীবন ইলম, ইবাদত, তাসাউফ, এবং মানবতার খেদমতে কাটিয়ে ৯১ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন। তিনি ৫৬১ হিজরি, ১১৬৬ খ্রিস্টাব্দে ১১ রবিউস সানি তারিখে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর আগে তিনি অসুস্থ অবস্থাতেও আল্লাহর জিকির, নামাজ ও দোয়ার মধ্যে লিপ্ত ছিলেন। তাঁর শেষ কথাগুলোর মধ্যে ছিল: "এ মুহূর্তে আমার হৃদয়ের দরজা আল্লাহর নূরে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। আমি তাঁর সাক্ষাতে যাচ্ছি, তাঁর প্রেমে ডুবে আছি।" তিনি শান্তভাবে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেন, যেন তিনি চিরনিদ্রায় নয়—আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যাচ্ছেন।
তাঁর ওফাতের সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার মানুষ বাগদাদে তাঁর জানাজায় উপস্থিত হয়। তাঁর দাফন সম্পন্ন হয় বাগদাদে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা ও খানকার পাশেই, যা বর্তমানে "মাজারে গাউসুল আজম" নামে পরিচিত। যুগে যুগে লক্ষ লক্ষ মুসলমান তাঁর কবর জিয়ারত করেন এবং তাঁর দোয়া ও দিকনির্দেশনার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন।
মৃত্যুর পরও তাঁর তরিকত, শিক্ষা, এবং দাওয়াত আজও বিশ্বব্যাপী লক্ষ কোটি মানুষের জীবনকে আলোয় ভরিয়ে রেখেছে। তিনি তাঁর পবিত্র জীবন ও কর্মের মাধ্যমে ইসলামি ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর মৃত্যুকে দুনিয়াবাসীর জন্য দুঃখের হলেও, আধ্যাত্মিক জগতে তা ছিল এক মহান আত্মার আল্লাহর সান্নিধ্যে প্রত্যাবর্তনের আনন্দময় মুহূর্ত।
🔹 প্রখ্যাত গ্রন্থসমূহ:
হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহঃ) কেবল একজন আধ্যাত্মিক সাধকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক উচ্চস্তরের আলেম, পণ্ডিত ও লেখক। তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহ ইসলামি দর্শন, ফিকহ (ইসলামি আইন), তাসাউফ (আধ্যাত্মিকতা), দাওয়াত, আত্মশুদ্ধি ও জীবনের নৈতিক দিকনির্দেশনা প্রদানকারী হিসেবে যুগে যুগে মুসলিম উম্মাহর জন্য দিশারী ভূমিকা পালন করেছে। তাঁর লেখাগুলো সহজ ভাষায় গভীর অর্থ বহন করে, যা পাঠকের অন্তরে আধ্যাত্মিক আলো ছড়িয়ে দেয়।
তাঁর সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হলো “আল-ফতাওয়াল কাদিরিয়া” বা “ফতাওয়ায় গাউসিয়া”, যেখানে তিনি বিভিন্ন ইসলামি মাসআলা (ধর্মীয় প্রশ্ন) ও জটিল ফিকহি বিষয়ে গভীর বোধসম্পন্ন উত্তর প্রদান করেছেন। এটি ইসলামি ফিকহের একটি অমূল্য রত্ন এবং বহু আলেম ও মুফতিদের গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু। এই ফতোয়া গ্রন্থে তাঁর গভীর জ্ঞানের স্বাক্ষর স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়।
আরেকটি বিখ্যাত গ্রন্থ “গুনইয়াতুত তালিবীন” (Gunyat ut-Talibin), যেখানে তিনি একজন মুমিন কীভাবে জীবনযাপন করবে, আত্মিক উন্নয়ন সাধন করবে, ইবাদত করবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে চলবে—তা সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এটি তাঁর তাসাউফ ও দাওয়াতি চিন্তার একটি অনন্য নিদর্শন।
তাঁর আরেকটি আলোচিত গ্রন্থ “ফুতুহুল গায়ব” (Futuh al-Ghaib), যা মূলত তাঁর ভাষণ ও বক্তৃতার সংকলন। এতে আত্মশুদ্ধি, আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল, দুনিয়ার মোহ পরিহার, এবং ইখলাসের গুরুত্ব নিয়ে হৃদয়গ্রাহী আলোচনা রয়েছে। এটি বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং আজও লাখো মুসলমানের অন্তরে প্রেরণা জাগায়।
এছাড়াও তাঁর লেখা অন্যান্য মূল্যবান গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে –
-
“জিলজাল”
-
“মক্তুবাত”
-
“বাসায়েহ”
-
“তাফসিরে জিলানী” (তাফসির সংক্রান্ত আলোচনা)
-
এবং আরও কিছু সংক্ষিপ্ত কিতাব ও আধ্যাত্মিক উপদেশমূলক পুস্তিকা।
এইসব গ্রন্থ শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম নয়, বরং আত্মার পরিশুদ্ধি ও আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গঠনের সেতুবন্ধন হিসেবেও কাজ করে। হযরত জিলানী (রহঃ)-এর এই মৌলিক রচনাসমূহ আজও বিশ্বজুড়ে মুসলিম সমাজে পঠিত, অধ্যয়নযোগ্য এবং গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত।
🔹 উপসংহার (অনুচ্ছেদ আকারে)
হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহঃ) ইসলামের ইতিহাসে এক অনন্য মহাপুরুষ, যিনি কেবল একজন সুফি সাধক বা আলেম নন, বরং ছিলেন ইলম, আধ্যাত্মিকতা, দাওয়াত ও মানবিক আদর্শের এক অপূর্ব মিলনমঞ্চ। তাঁর পবিত্র জীবন আমাদের শেখায় কীভাবে ইলম অর্জনের মাধ্যমে হৃদয় পরিশুদ্ধ করা যায়, কীভাবে আল্লাহর ভালোবাসায় আত্মা বিলীন করে দেওয়া যায়, এবং কীভাবে মানুষকে সত্য ও শান্তির পথে আহ্বান জানাতে হয়। তাঁর প্রতিটি শিক্ষা, বক্তব্য ও কর্ম আজও মানুষকে আলোর পথে ডাকে এবং অন্তরের অন্ধকার দূর করে।
তিনি ছিলেন এমন এক আলোকবর্তিকা, যার আলো শুধু তাঁর সমকালেই নয়, বরং যুগে যুগে, দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কাদিরিয়া তরিকা আজও বিশ্বজুড়ে লক্ষ কোটি মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনের অবলম্বন। তাঁর কারামত, শিক্ষা, দাওয়াত, ও সাহিত্য—সবকিছুই এক বিশ্বজনীন আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য হয়ে রয়েছে।
হযরত জিলানী (রহঃ)-এর জীবন থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ, মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়োগ, এবং নিজের অন্তরকে শুদ্ধ করে আত্মিক উন্নতির পথে চলার প্রেরণা। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন—একজন মুসলমান কেবল নামাজ-রোজায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং আত্মিক বিশুদ্ধতা, ইখলাস এবং মানবিক গুণাবলীর মাধ্যমে একজন প্রকৃত মু’মিন হয়ে ওঠে। তাঁর জীবনের আদর্শ অনুসরণ করে আজও আমরা নিজেদেরকে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি।
What's Your Reaction?






